ইসতিয়াক আহমেদ তাহের
“আপনি যখন আপনার মোবাইল ফোন থেকে এ্যাপ দিয়ে কোন খাবার অর্ডার করেন, তখন আপনি রিয়েল টাইমে আপনার অর্ডারটির স্ট্যাটাস জানতে পারেন । যেমন আপনি জানতে পারেন, এখন আপনার খাবার প্রস্তত হচ্ছে বা ডেলিভারিম্যান অর্ডারকৃত খাবারটি পিক করেছে কিংবা আগামী দশ মিনিটের মধ্যে খাবার পৌঁছে যাবে ইত্যাদি। কিন্তু আপনি যদি একজন সাধারন চাকরীপ্রার্থীর দৃষ্টিকোন থেকে বিবেচনা করেন, চিত্রটি সম্পুর্ণ বিপরীত। কেন আপনাকে একটি চাকরীর আবেদন করার পর এ্যাপলিকেশন স্ট্যাটাস সম্পর্কে সম্পুর্ণভাবে অন্ধকারে থাকতে হবে ? আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর রিক্রুটমেন্ট প্রক্রিয়ায় কি এ ধরনের রিয়েল টাইম ভিসিবিলিটি বা স্বচ্ছতা আনা সম্ভব নয় ?”
সম্প্রতি মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে এইচআর টেকনলজি বিষয়ক একটি সেশনে একজন বক্তা উপরের বক্তব্যটি উপস্থাপন করছিলেন ।
বিশ্বব্যাপী কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা বা আরটিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স (এআই) প্রযুক্তির উদ্ভবের পর মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনায়প্রযুক্তির ব্যবহার আরও বৃদ্ধি পেয়েছে । এই এআই প্রযুক্তি কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়াকে কিভাবে প্রভাবিত করতে পারে এবং সামগ্রিকভাবে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহারে বাংলাদেশের অবস্খান কোথায়, এ নিয়েই আজকে আমার এই আলোচনা ।
যে কোন প্রতিষ্ঠান যখন কোন একটি পদে রিক্রুটমেন্ট প্রক্রিয়া শুরু করে, যোগ্যতা যাচাইয়ের প্রথম ধাপটি হল “স্ক্রিনিং” । পদটির চাহিদা অনুযায়ী ক্যান্ডিডেটদের ন্যুনতম অভিজ্ঞতা, শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং অন্যান্য যোগ্যতাসমুহ যাচাই করে প্রথম শর্ট লিস্টটি করা হয় । এ কাজটি করতে প্রতিষ্ঠানটি এ্যাপ্লিক্যান্ট ট্র্যাকিং সিস্টেম (এটিএস) এর মত প্রযুক্তি ব্যবহার করে কিংবা যাদের এটিএস নেই, তারা কাজটি ম্যানুয়েলি করতে পারেন । এটিএস এক্ষেত্রে পদটির জব ডেস্ক্রিপশন (জেডি) ও পারসন স্পেসিফিকেশান (পিএস) অনুযায়ী প্রার্থীদের রেজিউমেতে উক্ত পদের সংশ্লিষ্ট কিওয়ার্ডগুলো সার্চ করে স্ক্রিনিং প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করে । আর এ কাজটি ম্যানুয়েলি করলে রিক্রুটারগন একইভাবে জেডি ও পিএস এর ভিত্তিতে নিরীক্ষার মাধ্যমে স্ক্রিনিং প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করেন ।
ধরুন একটি শুন্য পদে ১,০০০ জন প্রার্থী চাকরির আবেদন করলেন । এর মধ্যে স্ক্রিনিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ২০ জনকে প্রাথমিকভাবে ইন্টারভিউ কিংবা লিখিত পরীক্ষার জন্য নির্বাচন করল । অর্থাৎ এক্ষেত্রে প্রতি ১০০ জনে ২ জন প্রার্থী পরবর্তী ধাপের জন্য নির্বাচিত হলেন ।
এখন আসুন আলোচনা করি এই জেনারেটিভ এআই প্রযুক্তি কিভাবে এই রিক্রুটমেন্ট প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে ?
চ্যাটজিপিটির মত অনেক ইন্টারনেট-নির্ভর টুল আছে যার মাধ্যমে প্রথমে আপনি কোন একটি জব এ্যাডের বিপরীতে আপনার বর্তমান রেজিমিউটি গ্রহন হওয়ার ক্ষেত্রে কত সম্ভাবনা আছে তা যাচাই করতে পারবেন । এসব জেনএআই টুল জব ডেসক্রিপশন ও আপনার রেজিমিউটিকে স্ক্যান করে বলে দিবে যে, ধরুন “৪০% বা ৫০% ম্যাচ”।
দ্বিতীয় ধাপে ঐ একই জেনএআই টুলের মাধ্যমে আপনি উক্ত জবের জন্য আপনার রেজিমিউটিকে ৮০% বা ততোধিক ম্যাচ করে নতুনভাবে জেনারেট করতে পারেন । এখন আপনি যদি এই নতুন রেজিমিউটি দিয়ে উক্ত জবের জন্য আবেদন করে থাকেন, তবে খুব সহজেই আপনি স্ক্রিনিং প্রক্রিয়াটি অতিক্রম করতে পারবেন ।
এখন সমগ্র পরিস্থিতিটি নিয়ে একটু ভাবুন । আপনি যদি আপনার ৪০% ম্যাচ রেজিমিউকে জেন এআই টুল ব্যবহার করে ৮০% বা ৯০% ম্যাচ বানাতে পারেন, তবে জব মার্কেটে বাকি প্রার্থীরা কি চুপ করে বসে থাকবেন ? অধিকাংশ প্রার্থীই আপনার মত একইভাবে ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন টুল ব্যবহার করে তাদের রেজিমিউকেও উন্নত করবে এবং এটিএস বা রিক্রুটারের প্রাথমিক বাধা টপকে যাবেন । ফলে, আগে যেখানে ১,০০০ জনের মধ্যে ২০ জন স্ক্রিনিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শর্ট-লিস্টেড হয়েছিলেন, জেনএআই টুল ব্যবহার করে শুধু মাত্র উন্নততর রেজিমিউর কারনে এই শর্ট লিস্টেড প্রার্থীর সংখ্যা ২০ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৫০০ জনও হতে পারে । এখানে রিক্রুটারের অবস্থা হবে অনেকটা নব্বই দশকের জনপ্রিয় ব্যান্ড সংগীত, “মন কি যে চায় বল, যারে দেখি লাগে ভাল ….” এর মত !
কিন্তু বাস্তবে কোন রিক্রুটারই প্রাথমিক পর্যায়ে ৫০০ জন প্রার্থীর ইন্টারভিউ কিংবা লিখিত পরীক্ষা নিবেন না । তাই এ অবস্থা থেকে পরিত্রান পেতে রিক্রুটার তার এটিএস কিংবা ম্যানুয়েল স্ক্রিনিং প্রক্রিয়ায় নতুন কিছু ক্রাইটেরিয়া যোগ করবেন যেমন, বিশেষ কিছু তথাকথিত এলিট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা কিছু নির্দিষ্ট কোম্পানী । কিন্তু এর ফলে নিয়োগ প্রক্রিয়াটি হয়ে পরবে পক্ষপাতদুষ্ট এবং এলিটিস্ট ।
তবে, সাপের বিষের প্রতিষেধক যেমন ঐ বিষ থেকেই প্রস্তত হয়, তেমনি এআই থেকে উদ্ভব সমস্যার সমাধানও ঐ এআই থেকেই পাওয়া যাবে । এই সমাধান হল এআই ও মেশিন লার্নিং প্রযুক্তি নির্ভর স্বয়ংক্রিয় ভিডিও এ্যাডমিনিস্টার্ড ইন্টারভিউ এবং লিখিত পরীক্ষা ।
এই প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রার্থীগন একটি নির্ধারিত ওয়েব পেইজ এ লগইন করে একটি ক্যামেরার সামনে তার ইন্টারভিউ বা লিখিত পরীক্ষা দিয়ে যাবেন। এআই প্রযুক্তি এই রেকর্ডকৃত ইন্টারভিউটি বা লিখিত পরীক্ষা স্বয়ংকৃতভাবে এ্যানালাইসিস করে সাথে সাথেই প্রার্থীর পরীক্ষার স্কোর নির্ধারন করবে। এ পদ্ধতিতে নিম্নোক্ত সুবিধাগুলো পাওয়া যাবে:
১। অধিক পরিমানে ইন্টারভিউ (এবং লিখিত পরীক্ষা) নেয়া যাবে এবং কোন ইন্টারভিউয়ার বা পরীক্ষা হলে পরিদর্শকের প্রয়োজন হবে না ।
২। ইন-পারসন ইন্টারভিউয়ের একটি নিগেটিভ দিক হল জ্ঞাত বা অজ্ঞাত পক্ষপাতদুষ্টতা । ভিডিও এ্যাডমিনিস্টার্ড পদ্ধতিতে ইন্টারভিউতে এই পক্ষপাতদুষ্টতা ব্যতীত ফলাফল পাওয়া যাবে ।
৩। এই পদ্ধতি প্রার্থীর জন্যও অনেক সাশ্রয়ী হবে । তাকে জানজট ঠেলে এসে কোম্পানীর রিসেপশনে পরীক্ষার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে হবে না । ফলে কোম্পানীর এম্প্লয়ার ব্র্যান্ড ইমেজ উন্নত হবে ।
৪। প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে এই স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির পরীক্ষা অনেক দ্রুত প্রার্থীর যোগ্যতা বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়, তাই অনেক দ্রুততর সময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যাবে ।
৫। এই পদ্ধতিতে পরীক্ষায় প্রার্থী যেন কোন অসদুপায় অবলম্বন করতে না পারে সে জন্য বিভন্ন ফিচার থাকে । যেমন কম্পিউটারে পরীক্ষার পেইজটি ব্যতীত অন্য কোন উইনডো খুলতে না পারা, আই-বল ট্র্যাকিং ফিচার ইত্যাদি ।
তবে একথাও বলতে দ্বিধা নেই, এসকল সফ্টওয়্যার কিন্তু এখনও পুরোপুরিভাবে মানুষের বিকল্প হয়ে উঠেনি । বর্তমানে এ সকল সফটওয়্যার রিক্রুটমেন্টে প্রক্রিয়ার কর্মদক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করছে মাত্র । যোগ্য প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আমরা এখনও আগের মতই সুযোগ্য পেশাজীবীদের অভিজ্ঞতা, বিচক্ষণতা এবং পারদর্শিতার উপরই নির্ভরশীল । এআই এখনও প্রার্থীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট যেমন নেতৃত্বদান, টিমওয়ার্ক, মানষিক দৃঢ়তা, সহমর্মিতা এবং প্রতিষ্ঠানের কালচার ইত্যাদি যাচাই করার মত সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি । রিক্রুটমেন্ট প্রক্রিয়ায় এসকল বিষয়ে আমরা এখনও মানুষের সক্ষমতার উপরই পুরোপুরি নির্ভরশীল ।
এখন দেখা যাক মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তি ব্যবহারে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায় ?
বাস্তবতা হল, আমাদের দেশীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলা কর্মস্থলে টেকনলজি এ্যাডপশনের ক্ষেত্রে এখনও অনেক পিছিয়ে আছে । বিশেষ করে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনায় সমগ্র বিশ্ব যখন এইচআর এ্যানালাইটিকস, টোটাল রিওয়ার্ড, পারফরম্যান্স ম্যানেজমেন্ট, এম্প্লয়ি এনগেজমেন্ট ও ওয়েলনেস, এম্প্লয়ার ব্র্যান্ডিং, ডাইভার্সটি ও ইনক্লুশন ইত্যাদি ক্ষেত্রে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্যাপকহারে কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করে চলেছে, আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও খুব প্রাথমিক পর্যায়ের এইচ আর আই এস (হিউম্যান রিসোর্স ইনফর্মেশন সিস্টেম), এ্যাটেনড্যান্স ম্যানেজমেন্ট ও এ্যাকসেস কন্ট্রোল সিস্টেম কিংবা পেরোল ম্যানেজমেন্ট নিয়েই হিমশিম খাচ্ছে ।
গত বছর একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে এইচআর প্রযুক্তি বিষয়ক সেশনে এক বক্তা বলছিলেন, তার প্রতিষ্ঠান এমন একটি এআই-নির্ভর সফ্টওয়্যার নিয়ে কাজ করছে, যা কিনা এমন একটি এলগরিদমের উপর ভিত্তি করে কাজ করে যা ঐ প্রতিষ্ঠানের এম্প্লয়ি টার্নওভার ডেটাবেইস এবং এম্প্লয়ি প্রোফাইল এ্যানালাইসিস করে আগামী তিন থেকে ছয় মাসের মধ্য কোন কোন যোগ্যতা সম্পন্ন কর্মী উক্ত প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে যেতে পারে তার একটি সম্ভাব্য তালিকা প্রস্তত করে । উক্ত তালিকার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠানের মানব সম্পদ কর্মী ও সংশ্লিষ্ট কর্মীদের ম্যানেজারগন ঐ সকল কর্মীদের ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার প্ল্যান এবং দক্ষতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে তাদের সাথে আলোচনা করেন । এ পদ্ধতিতে তারা অনেক যোগ্য কর্মীদের প্রতিষ্ঠানে ধরে রাখতে সক্ষম হচ্ছেন । এখন আমাদের দেশের কথা একবার চিন্তা করুন । এদেশের দেশীয় ভাল প্রতিষ্ঠান গুলোতেও এ ধরনের কার্যক্রম বড়জোর কোন যোগ্য কর্মী ইস্তফা দেয়ার পর তার এক্সিট ইন্টারভিউ নেয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে ।
ব্যক্তিগতভাবে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক এইচআর কনফারেন্সে অংশগ্রহনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এদেশের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানগুলো মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বর্তমানে যে পর্যায়ে আছে, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত প্রায় দুই দশক আগেই এ পর্যায় পেরিয়ে এসেছে । এক্ষেত্রে আমাদের এই পশ্চাদমুখিতা সত্যিই দুঃখজনক । হতে পারে সস্তা শ্রমের অতীব সহজলভ্যতা আমাদেরকে কর্মক্ষেত্রে এতটা প্রযুক্তি-বিমুখ হতে উৎসাহী করেছে ।
আশা করি শীঘ্রই আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তি ব্যবহারের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন হবেন এবং এ বিষয়ে অধিকতর বিনিয়োগের মাধ্যমে তাদের কর্মী বাহিনীর দক্ষতা বাড়াতে সচেষ্ট হবেন । সরকার এবং বেসরকারী উভয় ক্ষেত্রের নেতৃত্বকেই বুঝতে হবে, যদি আমরা সত্যিই ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বিশ্বের কাতারে শামিল হতে চাই, তবে স্বস্তা শ্রমকে পুঁজি করে এই কাংখিত অর্জন সম্ভব হবে না । এই যোগ্যতা আমরা একমাত্র আমাদের জনশক্তির দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমেই অর্জন করতে পারব এবং এক্ষেত্রে আমাদের মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তি ব্যবহার বৃদ্ধির কোনই বিকল্প নেই ।
ইসতিয়াক আহমেদ তাহের পেশায় একজন মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক পরামর্শক
দৈনিক প্রথম আলেতে প্রকাশিত এ লিখাটি: https://www.prothomalo.com/opinion/column/awq3183al7
Good observation. Highly recommend. This will not only save unproductive labor hours but also provide a competitive advantage at every phase of the recruitment funnel. Strategically, the organization will enjoy better brand value by providing a satisfying candidate experience.